মধুমতি নদীর ভাঙ্গনরোধ প্রকল্পে পাড় রক্ষায় পাকাবাধ নির্মাণ কাজের জন্য ৪৮০ কোটি টাকার প্রকল্পটি পাস করিয়েছিলেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (ওয়াপদা) ঢাকা কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ২০২২ সালে ততকালীন ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ প্রয়াত মনজুর হোসেন ।
মধুখালী উপজেলার সালামতপুর থেকে আলফাডাঙ্গা উপজেলার বাজড়া পর্যন্ত ২৮টি প্যাকেজে ভাগ করে ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি বর্তমান চলমান রয়েছে এবং ৮০ কোটি টাকা গচ্ছিত রাখা হয়েছে প্রকল্পের কাজ শেষে পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
দুই বছর প্রকল্পের মেয়াদ হলেও ইতিমধ্যে দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি নেই বেশিরভাগ প্যাকেজে, কাজে ঢিলেঢালা ভাব।
প্রকল্পগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, মূল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নেভী থেকে অবসরপ্রাপ্ত প্রয়াত নকীব হোসেনের নকীব গ্রুপ ও ওয়েষ্টর্ন গ্রুপ হলেও তাদের পাত্তাই নেই প্রকল্পে। তাদের থেকে সাব-ঠিকাদার নিয়ে প্যাকেজ গুলোতে কাজ করছেন ২৩ জন সাব ঠিকাদার।
বেশিরভাগ ঠিকাদার এ কাজে নতুন, নেই পূর্বাভিজ্ঞতা, কাজে অগোছালো ও অপরিকল্পিত ভাব। ফলে প্রকল্পের কাজ কোথাও দ্রুতগতিতে এগিয়েছে, কোথাও বালুর বস্তা ডাম্পিং হয়নি। আবার কেউ কেউ প্রথমেই ব্লক তৈরির কাজ শুরু করেছেন বস্তা ডাম্পিংয়ের আগেই।
তৈরিকৃত ব্লকে মাঠ পূর্ণ থাকায় পরবর্তীতে বালুর বস্তার স্ট্রাইক সাজাতে জায়গার অভাব হচ্ছে। বালুর বস্তা ডাম্পিংয়ে অনিয়মতান্ত্রিক কাজের চিত্র দেখা গেছে সব প্যাকেজে।
সিডিউল অনুযায়ী নিয়মের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছাধীন কাজ করেছে লেবাররা। তীর থেকে পানির লেয়ার টু লেয়ার ফলো করে ৩৫ মিটার দূরত্বে বস্তা ডাম্পিং করেনি কোন ঠিকাদার। টাস্কফোর্স একই দিনে কয়েকটি প্যাকেজের বস্তা গণনা করতে গিয়ে সন্ধ্যারাত হয়ে গেছে; পরদিন সকালে গিয়ে দেখা যায় বিক্ষিপ্তভাবে দশ থেকে বারোটি বস্তায় রং পড়েনি।
ওই বস্তাগুলো দ্বিতীয়বার কাউন্টিংয়ে ধরানো হয়। সরকারিভাবে কাউন্টিং করা বস্তা দিয়ে যত্রতত্র একাধিক ঘাট বানিয়ে ফেলে রেখেছে দীর্ঘদিন। ফলে বস্তাগুলির সদব্যবহার হয়নি এবং বর্ষা মৌসুমে তীব্র স্রোতে ভাঙ্গন কবলিত স্থানে যথাযথ প্রটেকশন পায়নি যে কারণে ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে।
এসকেভেটর দিয়ে বস্তাগুলি নদীতে ফেলার কারনে নিরানব্বই ভাগ বস্তা ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। ফলে বস্তার কার্যকারিতা নামকাওয়াস্তে। এ যেন সরকারী-কা মাল, দরিয়ামে ঢাল অবস্থা।
সরকারিভাবে এ কাজ দেখভালের দায়িত্বে আছেন ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার রাকিব হোসেন। তাঁর নেতৃত্বে রয়েছেন সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার (এস.ডি) সন্তোষ কর্মকার, মেহেদী হাসান ও শশাংক কুমার বিশ্বাস।
ওনাদের সহযোগিতায় আছেন দশ থেকে বারো জন উপ-সহকারী প্রকৌশলী এবং প্রতিটি প্যাকেজে কাজ চলাকালীন একজন করে ওয়ার্ক এসিসট্যান্ট উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সরজমিনে গিয়ে কখনও কখনও পাওয়া যায়নি।
প্রতিটি প্রকল্প দেখভালের জন্য অফিস কক্ষ তৈরির নির্দেশনা থাকলেও কয়েকটি প্যাকেজে গিয়ে কোন অফিস কক্ষ নাই; বিশেষ করে বাঁশতলা ৪নং প্যাকেজ মেসার্স মোস্তফ এন্ড জুয়েল ব্রাদার্স এবং মনজিল ঠিকাদারের নওপাড়া ও চরনারানদিয়া প্যাকেজে কোন অফিস কক্ষ তৈরি করেনি।
কোন একটি প্রকল্পে কাজের বর্ণনা দিয়ে সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। এ কাজে সংশ্লিষ্ট সকলেই মুখে কুলুপ এটে কাজ করছেন। রাখরাখ ঢাকঢাক ভাবে কাজ করছেন। ওয়াপদার কর্মকর্তা বা ঠিকাদার কোন প্রকল্পের সিডিউল দেখতে চাইলে দেখাতে নারাজ। কোন ঠিকাদার ব্লক ম্যানুফ্যাকচারিং রেজিষ্টার তৈরি করেনি।
ঠিকাদারগণ এক বছরে যে টাকার কাজ করেছে তার এক তৃতীয়াংশ বিল পায় নাই বলে তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি কাজ করছে। আবার কাজও হচ্ছে নিম্নমানের। বস্তা ও ব্লক কাউন্টিংয়ের কাজে ঢাকা টাস্কফোর্সের সদস্য আসেন প্রতি সপ্তাহের শনিবার। টাস্কফোর্সের গণনাকালীন দেখা গেছে বিভিন্ন ত্রুটি। বস্তার সাইজ ও মান এবং সূতার কোয়ালিটি নিম্নমানের।
বালুর গুণগত মানে ও ওজনে ত্রুটি পাওয়া গেছে। বস্তা গণনায় ভুল পাওয়া গেছে।
আলফাডাঙ্গা উপজেলার বাঁশতলা ৩নং প্যাকেজের কাজ করছে রিনা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সাবঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। মালিক তপন কুমার পাল, অফিস ঢাকায়।
তিনশ মিটার কাজে ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ। ৭০ হাজার বস্তা, তিন সাইজের ৯০ হাজার ব্লক এবং ২৩ মিটার প্রসস্ত স্লব তৈরির কাজ করবেন এ ঠিকাদার। ৭৩৯৭টি বস্তা প্রস্তুত করেছিল ঠিকাদারের লোকজন। তারমধ্যে ৩৫৫৪টি বস্তার ওজন, বালুর মান ঠিক না থাকায় রিফিল করার নির্দেশ দেন টাস্কফোর্স। কিন্তু সেগুলো রিফিল না করেই নদীতে ডাম্পিং করা হয় বলে জানান এলাকাবাসী।
আবার ১৮শ অধিক বস্তা দুইবার গণনায় দিয়েছিলেন। এ প্রজেক্টে ব্লক তৈরির জন্য যে পাথর এসেছে তা সিডিউল পরিপন্থি হলেও ল্যাবটেস্টের জন্য পাঠানো হয়নি।
একই উপজেলার বাজড়া ৪নং প্যাকেজের ঠিকাদার বিপ্লব কুমার গুন। তার কাজ ৫০০ মিটার। টাস্কফোর্স কয়েকটি স্ট্রাইকে প্রায় কোটি টাকার ব্লক নিম্নমানের বলে বাতিল করলে তিনি দ্বিতীয়বার চ্যালেঞ্জ করে টেস্টের জন্য আপীল করেন। সে টেস্টের ফলাফল এখনও অব্দি আসেনি।
দিগনগর ২নং প্যাকেজের সাবঠিকাদার সাজেদুল ইসলাম রাজীব। তিনি ঢাকা জজকোর্টে ওকালতি ব্যবসা করেন বিধায় নিয়মিত প্রকল্প পরিদর্শনে আসতে পারেন না।
তার কাজ ২০০ মিটার। এ প্যাকেজেও ব্যাপক অনিয়ম দেখা গেছে। ওয়াপদা কর্মকর্তা এসে কাজে গাফিলতি ও অনিয়ম দেখে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
টাস্কফোর্স ২০টি বস্তা বাতিল করে। কিন্তু বস্তাগুলি ঠিকমত রিফিল না করে নদীতে ডাম্পিং করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে।
কামারখালী ১ থেকে ৬নং প্যাকেজগুলোতে দেখা যায় অনিয়মের চিত্র। বর্ষা মৌসুমে প্রবল স্রোতে তাৎক্ষণিক ভাঙ্গনরোধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। বালুর বস্তার কাজ একটু হয়নি।
কারণ কামারখালী গড়াই নদীর বালুর এফ, এম নাই। এ কারণে ঠিকাদাররা সিডিউল মাফিক, ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে বালু সংগ্রহ করতে পারছেন না।
এ.এস.আর.সি/মেসার্স রায়হান কনস্ট্রাকশন নামে যৌথ সাবঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ব্লক তৈরির কাজ করছে। কিন্তু কিউরিংয়ের কাজ করছে নাম মাত্র।
মধুখালী উপজেলার নওপাড়া ১ ও ২ নং প্যাকেজের আগে ও পরে; আলফাডাঙ্গা উপজেলার বাঁশতলা, দক্ষিণ চরনারানদিয়া এবং বাজড়া ১ ও ৪ নং প্যাকেজের আগে ও পরে নদীভাঙ্গন কবলিত মানুষের অভিমত, এত টাকা খরচ করে এ বাধ নির্মাণ কোন কাজেই আসবে না।
যদি না উপরোল্লিখিত জায়গাগুলোতে দেড়শ মিটার থেকে দুইশ মিটার করে নির্মাণ কাজ প্রসস্তকরণ না করা হয়। আবার বর্ষা মৌসুমে বাধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে এ বাধ ভেঙে যাবে। আরও দুই ফুট উঁচু করে বাধ নির্মাণ করলে পাকাপোক্ত ও পরিকল্পনা মাফিক কাজ হতো। দু- একটি বর্ষা না যেতেই ভেঙ্গে নস্যাত হয়ে যাবে।
সবকটি প্যাকেজে পাথর, সিলিকন বালু পৌঁছতে দশ চাকার ট্রাক প্রায় ৫০ টন ওজনের অতিভারি পরিবহন যাতায়াতে সড়কগুলোর অবস্থা নাজেহাল হয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার এলজিইডি’র আওতাধীন সড়কগুলো ভেঙ্গে গেছে। আলফাডাঙ্গা লোকাল বাসস্ট্যান্ড হতে বেড়ীরহাট পর্যন্ত নবনির্মিত পাকা সড়ক ভেঙ্গে বিশাল গর্ত হয়ে গেছে কয়েক জায়গায়।
আলফাডাঙ্গা থেকে বকজুড়ী জিসি সড়ক এবং অন্যান্য সড়কের বিসি লেয়ার, সোল্ডার চাপ ধরে ভেঙ্গে খোয়া উঠে গর্ত হয়ে গেছে। অতিভারী ৫০ টন ওজনের দশ চাকার ট্রাক চলাচলে গ্রামীণ নবনির্মিত সড়কগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে আলফাডাঙ্গা উপজেলা প্রকৌশলী রাহাত ইসলাম বলেন, নবনির্মিত গ্রামীণ সড়কগুলো স্থায়ীত্বের মেয়াদের আগেই ভেঙ্গে গেছে। পথচারীদের চলাচলে বিঘ্ন হচ্ছে।
দুর্ঘটনাও ঘটছে। অনতিবিলম্বে ওভারলোডেড যানবাহন চলাচল জরুরিভাবে বন্ধ করা প্রয়োজন।
এ সব বিষয় নিয়ে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মোঃ রাকিব হোসেন বলেন, ঠিকাদারদের কাজ করতে হবে সিডিউল মাফিক।
এর বাত্যয় হলে নিউজ করবেন, আমরা জানতে পারলে তদন্তপূর্বক বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিবো। আর গ্রামীণ সড়কের বিষয়ে আমি জানি উপজেলা এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ারও জানেন। উভয়ই সরকারি কাজ। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট আমরা জানাবো, সুপারিশ করবো।
কাজের তথ্য, সিডিউলের ফটোকপি এবং কোন বক্তব্য দিতে নারাজ।