জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলা যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে গারোপাহাড়ের গ্রাম বাংলার চির ঐতিহ্যের নিদর্শন সবুজ শ্যামল ছায়া – ঘেরা শান্তির নীড় মাটির তৈরি ঘর এখন বিলুপ্তির পথে। সচরাচর আর দেখা যায় না, এমন সুন্দর মাটির তৈরি এই ঘরগুলি। এক সময়ের মনোমুগ্ধকর বসবাসে আদিবাসীদের কাছে মাটির ঘর গরিবের এসি ঘর হিসাবে বেশ পরিচিত এই শান্তিরনীড় মাটির ঘর কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে।
ইট, বালু ও সিমেন্ট, টিন, কাঠের প্রাচীরঘেরা দুর্গে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই মাটির ঘরের কথা এখন আর কারও মনিকোঠায় নেই।
পাহাড়ি ঘেঁষা এই উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ধানুয়া কামালপুর সাতানিপাড়া,বালুঝুরি গারোপাহাড়ে আদিবাসীদের এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর প্রাচীনকাল থেকেই মাটির ঘরের প্রচলন ছিল, তা এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত এসব মাটির ঘর তৈরি হতো এঁটেল বা আঠালো মাটি কাঁদায় পরিনত করে, খড় বা টিন দিয়ে উপরে ছাউনি দেয়া হতো। এক সময় খড় – ছনের ছাউনিই ছিল বেশি।
বাপ-দাদার তৈরি করা মাটির ঘর সংস্কার করে কোনো কোনো স্থানে উপরে টিন ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বালুঝুড়ি গ্রামের আদিবাসী প্রমিলা সাংমা (৫৭) বলেন, আমাদের বাড়িতে ৩টি পরিবারের বসবাস। দেড় দশক (১৫ বছর) ধরে আমাদের বাড়ির প্রতিটা ঘর মাটির । যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে বাড়ির প্রতিটা ঘর পাকা হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসাবে একটি পাকা ঘর পেয়েছি। তিনি আরো বলেন, যতোই টিনের ঘর আর অট্টালিকায় থাকিনা কেন, মাটির ঘরে থাকার মতো যে স্বাচ্ছন্দ আর তৃপ্তিদায়ক।
ছন বাঁশের ছাউনির মাটির ঘরে প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশন হিসাবেই পরিচিত। প্রচন্ড গরমে আরাম দায়ক এই মাটির ঘরে বসবাস করলেও অন্যরকম শান্তির অনুভূতি পাওয়া যেত। শারীরিকভাবে সুস্থতায় থাকতো মানুষেরা। এখন প্রত্যেকটা গ্রাম ঘুরে কয়েকটি মাটির ঘর ছারা তেমন একটা খোঁজে পাওয়া যাবে না। দিন দিন মানুষ বড় বড় টিনের আধাপাকা ঘরে বসবাস করে, প্রাকৃতিক এই শান্তির নিবাস মাটির ঘর ভুলে গেছে। এদিকে, উপজেলার ধানুয়াকামালপুরের সাতানিপাড়া, সোমনাথ পাড়া, লাউচাপরা, বালুঝুরি,গারামারা, টিলাপাড়া,দিঘলকোনাসহ কিছু কিছু বাড়িতে মাটির ঘর এখনো দেখা যায়।
এসব এলাকায় বসবাসরত বাঙালী, গারো, মং ও চাকমারা জানান, প্রচন্ড গরম ও শীতে বসবাসের উপযোগী ছিল এই মাটির ঘর। ধনী – গরিব সবাই সেই মাটির ঘরে বসবাস করতেন। তবে কালের বিবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্ত হতে বসেছে মাটি দিয়ে তৈরি ঘর। ছন আর বাঁশের ছাউনিতে মাটির ঘর প্রাকৃতিক শান্তির নিবাস, আরাম দায়ক মনে করে এলাকার বাসিন্দারা। তাই এসব এলাকার কিছু কিছু পরিবার বাপ -দাদার তৈরি মাটির ঘর সংস্কার করে এখনো ধরে রেখেছেন।
রঙ্গিলা চাকমা বলেন, আমার ঠাকুরদাদু প্রায় ৪০/৫০ বছর আগে মাটির একটি ঘর নির্মাণ করেছিলেন। তখনকার সময়ে এই ঘরটি নির্মাণ করতে প্রায় ৩/৪ হাজার টাকা খরচ হয়। এখন এই ধরনের ঘর তৈরি করতে প্রায় ২৫/৩০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় আরাম দায়ক মাটির ঘর হারিয়ে যাচ্ছে। সাবেক মেম্বার অঞ্জলি বলেন, এই উপজেলার এই পাহাড়ি যায়গায় এখনো অনেক মাটির ঘর রয়েছে। বাপ – দাদার তৈরি করা এই মাটির ঘর প্রতি বছর কিছুটা মাটি দিয়ে সংস্কার করে আজও বসবাস করছেন।
ধানুয়াকামালপুর ইউনিয়নের বর্তমান মেম্বার ছামিউল হকসহ গারোপাহারের গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, মাটির ঘর শুধু শান্তিই ছিলোনা, ছিল গ্রাম বাংলার শিল্প, ঐতিহ্য ও সুন্দর্য্য। নিত্যনতুন আকর্ষণ ইট, বালু, টিন, সিমেন্টের তৈরি বিল্ডিংয়ের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে শান্তির নীড় নিদর্শন এই মাটির ঘর।