গত ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সারাদেশজুড়ে ভক্তি, নিষ্ঠা ও উৎসাহ, উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয় এ বছরের বসন্ত পঞ্চমী তথা ভাষা,সংগীত,কলা,বিদ্যা, সুর ও আমাদের বোধের জাগরণের দেবী সরস্বতীর আরাধনা। আমাদের কথা অর্থাৎ বাক্ দান করেন বলে তিনি বাগদেবী।আমাদের প্রথম লেখা তথা হাতেখড়িও হয় দেবীরই আশির্বাদে। তাঁর এক হাতে বীণা,তাই তিনি বীণাপাণি।এছাড়াও তাঁর আরো কিছু নাম রয়েছে। যেমন :বিরাজ, সারদা, ব্রাহ্মী, শতরূপা, মহাশ্বেতা, পৃথুধর, বকেশ্বরী।ঋগ্বেদ, পদ্মপুরাণ, চন্ডীসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়।শ্বেত পদ্মাসনা, শুভ্রবসনা, শ্বেতবর্ণে সুশোভিত দেবী নিষ্কলুষ চরিত্রের প্রতীক।তিনি দক্ষতা অর্জনের দ্বারা জীবনে শ্রী অর্জনে সাহায্য করেন, তাই মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের এ পঞ্চমী তিথিকে শ্রীপঞ্চমীও বলা হয়। বাংলাদেশ, নেপাল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,উত্তর ভারত,ইন্দোনেশিয়ার বালিসহ বিশ্বের বিভিন্নস্থানে দেবী সরস্বতীর পুজা ও আরাধনা অনুষ্ঠিত হয়।সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ছাড়াও শিখ, কোথাও কোথাও বৌদ্ধদের ভেতরও এ পুজোর প্রচলন রয়েছে।ছোট থেকে বড় সবাই যেন এই দিনটার জন্য মুখিয়ে থাকে। বিশেষ করে ছোটদের মধ্যে, পুজো আসার আগে থেকেই চলতে থাকে পুজোর প্রস্তুতি। দলবেঁধে পুজোর জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা, প্রতিমার অর্ডার দেওয়া,পুজো মন্ডপ সাজানো,প্রসাদ বিতরণ, কে কয়টা পুজো মন্ডপ ঘুরলো,কোন জামাটা পরলো এসবকিছু যেন অন্যরকম এক আমেজ সৃষ্টি করে।ভোর হতেই শীতের কুয়াশার ভেতর হলুদ মেখে স্নান, তারপর জামাকাপড় পড়ে মন্ডপে দৌড়, পুজোর যোগাড় করা,আলপনা দেওয়া,পুরোহিতের তাগাদা, সবাই মিলে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া এসব আসলে শুধু পুজোর আচার নয়,মনের বেঁচে থাকার রসদে পরিণত হয়।স্কুল-কলেজ সবজায়গাতেই এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় করে সরস্বতী পুজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে।জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে একই মাঠের ভেতর ৬৫/৭০টি বিভাগের পুজো, তাদের বিভিন্ন ধরনের নকশায় তৈরী পুজো মন্ডপ, হলের ভেতর মেলা,লাখো মানুষের ঢল, সন্ধ্যা থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসব যেনো বারবার যে কাউকে স্মৃতিকাতর করে তোলে।যদিও করোনা পরিস্থিতি এসবকিছুই এবার বদলে দিয়েছে।পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে জগন্নাথ হলেও এবার মাত্র একটি পুজো অনুষ্ঠিত হয়।দেশসেরা খ্যাতি পাওয়া রাজশাহী কলেজেও এবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্ষিপ্ত আকারে পুজো অনুষ্ঠিত হয়।এছাড়াও মফস্বল এলাকাগুলোতেও ছিলো পুজোর আমেজ।তবে কোভিডের জন্য সংখ্যাটা অন্য বছরের তুলনায় সেসব স্থানেও কম।আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাটাও এক্ষেত্রে একটা কারণ। যেমন:রাজশাহী জেলার আড়ানী পৌর বাজার এলাকা বরাবরই পুজো-পার্বণ, উৎসবের জন্য পরিচিত।
প্রতিবছর শুধু এ পৌর বাজার এলাকাতেই ৪০/৫০টি পুজো অনুষ্ঠিত হয়।এবার সেখানে প্রায় ২৮টি পুজো হয়। অন্যান্য গ্রামীণ এলাকাতেও পড়েছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রভাব। গতকাল ছিলো পুজো বিসর্জন পর্ব।বরাবরের মতো আড়ানী পৌর বাজারের সকল পুজো একত্রিত করা হয় আড়ানী মনোমোহিনী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গণে। তারপর একসাথে বের হয় বিসর্জন যাত্রা। রাস্তার দুই ধারে প্রতিবারের মতো মানুষ আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো বিসর্জন যাত্রা দেখার।পুরো এলাকা প্রদক্ষিণ করে পরে সন্ধ্যাবেলা একে একে আড়ানী মহাশ্মশান ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়।অনেক মানুষের ভিড় জমে সেখানে।আসলে সরস্বতী পুজো শুধু পুজো নয়, এ আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের প্রাঞ্জল আনন্দ এবং মানুষ হওয়ার শিক্ষার উৎস।শিক্ষাকে শুধু পুস্তকের ভেতর আবদ্ধ করে রাখা যায়না।এ বিশ্বব্রহ্মান্ড সে তো পুরোটাই শিক্ষাগ্রহণের জন্য রত্নভান্ডার স্বরূপ।চিন্তায় ও মননের ঔদার্য, উৎকর্ষতা,পবিত্রতা, শুদ্ধ বাণী, শুদ্ধ বুদ্ধি এইতো প্রকৃত শিক্ষা। এখানে সাহিত্য, গণিত যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি রাগ,খেয়াল, ধ্রুপদও সম গুরুত্ব বহন করে।কলা আর কৌশল তথা প্রযুক্তি এখানে সমভাবে বাঞ্ছনীয়।সরস্বতীর অর্থই তো তিনি সরসভাবে বহমান। সেক্ষেত্রে আমাদের চিন্তাধারা কেনো আটকে থাকবে নির্দিষ্ট কোনো বাঁধাছকে?দেবী সরস্বতীর শুভ্রতার মতন শান্তি ছড়িয়ে পড়ুক সারাদেশে তথা সারাবিশ্বে।তাঁর আশির্বাদে আমাদের হৃদয় হোক পবিত্র,দৃষ্টি হোক সমুদ্রের মতো বিশাল,ভাবনা হোক হিমালয়ের মতো উচ্চ, সহিষ্ণুতা হোক ধরিত্রীমাতার মতো।ভালো থাকুক পৃথিবী, ভালো থাকুক প্রাণের স্পন্দনগুলো।
ঋতু কর্মকার
শিক্ষার্থী,রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।